Mother Teresa Biography in Bengali - মাদার তেরেসার জীবনী
ভূমিকা: আর্ত মানবতার মহান সেবিকা, মহীয়সী নারী মাদার টেরিজা—প্রেম, শান্তি ও আশ্রয়ের প্রতীক একটি নাম। নিপীড়ন, শোষণ ও নিষ্ঠুরতার হাত থেকে মানুষকে মুক্তি দেবার জন যেসকল মহা মানব অশেষ কষ্ট ভোগ করেছেন আজীবন, অকাতরে প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছেন, মাদার টেরিজা তাঁদেরই শেষ উত্তরাধিকারী। আজকের যুগে এমন মানুষ দুর্লভ হয়ে পড়েছে।
জন্ম ও শৈশব কাল: ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের যে বছর মৃত্যু হয় । সেই ১৯১০ সালের ২৭শে আগষ্ট এক আলবেনিয় রোমান ক্যাথলিক কৃষক পরিবারে মাদার টেরিজা জন্মগ্রহণ করেন । সেই স্থানটি ছিল তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলের একটি ছোট্ট গ্রাম স্কোপজে (Skopje)। কারো সাথে কারো সম্পর্ক নেই, অথচ মনে হয় যেন নাইটিঙ্গেল সবার অলক্ষ্যেই তাঁর হাতের সেই শান্তি, সেবা ও শুশ্রূষার প্রদীপটি ধরিয়ে দিয়ে গেছেন মাদার টেরিজার হাতে। তাঁর যথার্থ উত্তরসূরীর হাতে । প্রেম, করুণা, মায়া-মমতা, সেবা-শুশ্রূষার এক জীবন্ত প্রতিমা মাদার টেরিজা।
তাঁর পিতার নাম নিকোলাস বোজাকসহিউ, মাতার নাম দ্রোনাফাইল । তাঁর পিতা বোজাঝিউ পেশায় ছিলেন মুদি । তিনি মেয়ের নামকরণ করেছিলেন অ্যাগনেস গোনক্সহা বোজাকসহিউ (Agnes Gonxha Bojaxhiu ) ।
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল আহত পঙ্গু অসহায় আর্ত সৈনিক ও উনবিংশ শতাব্দীর এক মহীয়সী নারী ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকে বলা হতো ‘লেডি । মানুষদের সেবাশুশ্রূষা করে কতো মুমূর্ষু মানুষের জীবন প্রদীপকে নিভে যাওয়া হতে রক্ষা করেছেন । তেমনি আর এক নাইটিঙ্গেল প্রতিনিয়ত এই উপমহাদেশের, এ মহানগর কলকাতায় বিলিয়ে গেছেন তাঁর স্নেহ, মমতা, শান্তি ও সেবা। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের যোগ্য উত্তরাধিকারিণী হলেন এই মহীয়সী নারী মাদার টেরিজা ।
আলবেনিয়ার এই দরিদ্র দম্পতি কোনও দিন ভাবতে পারেননি তাঁদের অতি শান্ত কন্যাটি একদিন পৃথিবীর যাবতীয় দুঃখ মোচনের স্বপ্নকে রূপ দেবার জন্য নিজের জীবনকেই উৎসর্গ করবেন। ছোট্ট মেয়েটি করুণাময় যিশু আর মাতা মেরির ছবির সামনে চোখবন্ধ করে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে যে শক্তির প্রার্থনা করতেন তা ছিল তাঁদের অজানা। ঈশ্বরের কাছে এই নীরব প্রার্থনাই ছিল মাদারের যাবতীয় শক্তির উৎস। পরবর্তী জীবনেও যতই কাজ থাক প্রার্থনার সময়টি তিনি প্রায় সামরিক নিয়মের কঠোরতায় রক্ষা করেছেন। অ্যাগনেসরা ছিলেন দুই বোন ও এক ভাই। তাঁর একটা পা ছিল কৃশ। শারীরিক এই বিকৃতির জন্য একটা লজ্জার আবরণ তাঁকে ঘিরে থাকতো সব সময়। সাত বছর বয়সে অ্যাগনেস পিতৃহীন হন । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত যুগোস্লাভিয়ায় তাঁর মা অনেক কষ্টে লালন পালন করেন সন্তান কটিকে। মায়ের প্রেরণাতেই দরিদ্রের প্রতি দয়া ও ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি বিশ্বাস লাভ করেছিলেন অ্যাগনেস। অল্প বয়স থেকেই ধর্মীয় কাজকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি।
শিক্ষাজীবন: স্কোপজের পাবলিক স্কুলে পড়বার সময়েই সোডালিটি সংঘের মিশনারিদের কাজকর্মের প্রতি অ্যাগনেসের মন আকৃষ্ট হয়। তিনি সঙ্ঘের পত্রপত্রিকাগুলি নিয়মিত পড়তেন । ওই পত্রিকাতেই ভারতের নানা খবর প্রকাশিত হত । তাঁর নিজের কথায়, “At the age of twelve I first knew I had a vocation to help the poor. I wanted to be a missionary. স্কোপজে পাবলিক স্কুলের ক্লাশে যুগোস্লাভিয়ার জেসুইটদের চিঠি পড়ে শোনানো হতো। ওই সব চিঠিতে কোলকাতার কথাও বিশেষভাবে থাকতো। সে সব শুনে শুনেই কলকাতার প্রতি একটা আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল অ্যাগনেসের মনে।
লরেটা সংঘে যোগদান: মাদার টেরিজা খবর নিয়ে জানতে পারলেন আয়ারল্যান্ডের লরেটো সঙ্ঘ ভারতে কাজ করছে। তিনি লরেটো সঙ্ঘের প্রধান কার্যালয় ডাবলিনে যোগাযোগ করেন । তারপর মায়ের অনুমতি নিয়ে আয়ারল্যান্ডের বাথার্নহামে গিয়ে লরেটো সঙ্ঘে যোগ দিলেন ।
মাদার তেরেসা - (Mother Teresa)
জন্ম (Birthday)
২৬ আগস্ট ১৯১০
জন্মস্থান (Birthplace)
ইউস্কুপ, অটোম্যান সাম্রাজ্য
অভিভাবক/পিতামাতা (Parents)
নিকোলাস বােজাকসহিউ (পিতা) / দ্রোনাফাইল (মাতা)
জাতীয়তা
ভারতীয়
নাগরিকত্ব
ভারত (১৯৪৭-১৯৯৭)
পেশা (Occupation)
ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী, ধর্মপ্রচারক
পরিচিতির কারণ
দ্য মিশনারিজ অফ চ্যারিটি
পরিচিতির কারণ
দ্য মিশনারিজ অফ চ্যারিটি
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার
নোবেল শান্তি পুরস্কার (১৯৭৯)
ভারতরত্ন (১৯৮০)
প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম (১৯৮৫)
বালজান পুরস্কার (১৯৭৮)
মৃত্যু (Death)
৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ (5th September 1997)
মাদার টেরিজা ১৯২৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে মিশনারীর সেবাব্রত নিয়ে ভারতের কলকাতায় আসেন। তাঁকে এই সেবাব্রতে আত্মনিয়োগে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেন আয়ারল্যাণ্ডের অধিবাসিনী এমনি এক মহীয়সী নারী সেবিকা-সন্ন্যাসিনী লরেটা।
প্রথম বাংলার মাটি চরণ ছুঁয়ে তাঁকে বরণ করে নিল। সেই শুরুর দিন থেকেই অ্যাগনেস মনে প্রাণে হয়ে গেলেন বাংলারই মানুষ। তখনো পর্যন্ত তিনি পুরো সন্ন্যাসিনী হন নি। শিক্ষানবিশী পর্ব শেষ করার জন্য তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হল দার্জিলিঙে। দুবছরের পাঠক্রম শেষ করে গ্রহণ করলেন সন্ন্যাসিনী ব্রত। সিস্টার অ্যাগনেস হয়ে ফিরে এলেন কলকাতায়।
কর্মজীবন: মাদার টেরিজা এন্টালি সেন্ট মেরিজ স্কুলের বাংলা বিভাগে শিক্ষায়িত্রী হিসেবে নিযুক্ত হলেন। তাঁর পড়াবার বিষয় ছিল ভূগোল ও ইতিহাস। কুড়িবছর তিনি ওই স্কুলের শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। ১৯৪২ খ্রিঃ হন ওই স্কুলের অধ্যক্ষা। স্কুলে শিক্ষকতার সময়েই নিকটস্থ মতিঝিল বস্তির বাসিন্দাদের দারিদ্র্য, শিশুদের কষ্ট তাঁকে গভীরভাবে বিচলিত করে। সেটা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাল।
মানুষের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে শহর কলকাতার তখন নাভিশ্বাস। দুমুঠো ভাতের আশায়, একবাটি ফ্যানের আশায় দলে দলে গ্রামের মানুষ ভিড় করছে কলকাতায়, অনাহারে কুখাদ্য খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে মারা যাচ্ছে। সিস্টার অ্যাগনেস এই সময়েই শুরু করলেন তাঁর কাজ। অচিরেই তিনি বুঝতে পারলেন পেছনে বন্ধন রেখে দরিদ্র আর্তের সেবা হয় না। এখনাকার অতি দীন ক্ষুধার্ত মানুষদের পাশে আশা-ভরসার ঝুলি নিয়ে দাঁড়াতে হলে তাঁকে চার দেয়ালের গন্ডির নিশ্চিন্ত জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আধ্যাত্মিক জীবন: ১৯৪৬ খ্রিঃ ১০ই সেপ্টেম্বর দার্জিলিং যাওয়ার সময় এক অলৌকিক কথা উপলব্ধি হল তাঁর। তিনি যেন ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ শুনতে পেলেন । এই উপলব্ধির কথা বলতে গিয়ে মাদার নিজেই বলেছেন, “…a call within a call ………. The message was clear. I was to leave the convent and help the poor, while living among them.”
গরিবের সেবা করতে হলে গরিব হয়ে তাদের মধ্যে থেকেই তা করতে হবে। ঈশ্বরের এই আদেশ লাভের দিনটিকে আমৃত্যু স্মরণ করতেন মাদার। তিনি বলতেন দ্য ডে অব ডিসিশন—অনুপ্রেরণার দিন । সিস্টার অ্যাগনেস থেকে মাদার টেরিজায় রূপান্তরিত হবার সেই ছিল সূত্রপাত।
মাদার প্রতিষ্ঠিত মিশনারিজ অব চ্যারিটি এই দিনটিকে অনুপ্রেরণা দিবস হিসেবে পালন করে। সঙ্ঘ মনে করে ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬ খ্রিঃ তাঁদের সঙ্ঘের গোড়াপত্তন হয়। মাদার সুপিরিয়রের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে অ্যাগনেস লোরেটোর কাজ ছেড়ে দিলেন। লোরেটো সন্ন্যাসিনীদের আলখাল্লা ছেড়ে অঙ্গে তুলে নিলেন মোটা নীলপাড় শাড়ি । সেদিন তাঁর সম্বল বলতে ছিল পাঁচটি টাকা, একটি বাইবেল, ক্রস গাঁথা একটা জপের মালা।
আর সঙ্গে ছিল অকল্পনীয় মনোবল আর ঈশ্বরে নির্ভরতা। পিতৃদত্ত নাম বদলে নিজের নামকরণ করলেন টেরিজা। সিস্টার টেরিজা ফ্রান্সের সাধ্বী টেরিজা ১৮৯৭ খ্রিঃ মাত্র ২৪ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন। দরিদ্র এই সন্ন্যাসিনীই হলেন মাদার টেরিজার পথপ্রদর্শক। পুরোপুরিভাবে কাজে নামবার আগে নিজেকে আর একটু গড়েপিটে নেবার দরকার। পাটনায় গিয়ে দি সোসাইটি অব ক্যাথলিক মেডিক্যাল মিশনারিজ পরিচালিত একটি হাসপাতালে প্রাথমিক টিকিৎসার ট্রেনিং নিলেন।
১৯৪০ খ্রিঃ ফিরে এলেন কলকাতায়। এসে উঠলেন লিটল সিস্টার্স অব দি পুয়োর সঙ্ঘের সন্ন্যাসিনীদের আশ্রয়ে। তারপর সেখান থেকে উঠে এলেন মতিঝিল বাস্তির পাঁচটাকা ভাড়ার একটা ঘরে। সেই বছরই তিনি ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেন।
শুরু হল তাঁর দুর্গত মানবিকতার কল্যাণে কঠোর সংগ্রাম। এখানেই শুরু করলেন প্রথম স্কুল – গাছতলায় গুটিকতক বাচ্চাকে অ-আ-ক-খ শেখানোর মাধ্যমে। পড়ানো শেষ করে তিনি যেতেন কর্পোরেশনের মেথরদের মহল্লায়। তাদের সংসারের খোঁজখবর নিতেন। অসুস্থদের সেবাসুশ্রূষা করতেন। তারপর বেরুতেন ভিক্ষায় অর্থ আর ওষুধ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। সারাদিন বস্তিতে আর পথে কাটিয়ে রাতে শুতে যেতেন লোয়ার সার্কুলার রোডে সেন্ট যোশেফ হোমে। বৃদ্ধাদের এই আশ্রমে তিনি তাদের সেবা করতেন।
মিশনারিস অফ চ্যারিটি: ১৯৫০ খ্রীস্টাব্দে একান্ত নিঃস্ব অবস্থায় মাত্র আটজন সন্নাসিনীকে সঙ্গে নিয়ে ৬৪এ, লোয়ার সার্কুলার রোডে শুরু করলেন তাঁর প্রথম সেবাব্রতের কাজ । এই রাস্তাটির নাম বর্তমানে জগদীশচন্দ্র বোস রোড। স্থাপন করলেন তাঁর মিশনারী অব চ্যারিটি।
এভাবেই কলকাতায় তিনি আত্মনিয়োগ করলেন মানুষ ও মানবতার সেবায়। মনপ্রাণ ঢেলে দিলেন নিপীড়িত দুস্থ দরিদ্র অসহায় মানবতার সেবায় । তিলে তিলে গড়ে তুলতে লাগলেন তাঁর সেবা প্রতিষ্ঠান । দুঃখি দুস্থ আর্ত জর্জরিত মানুষকে তিনি একান্ত মায়ের স্নেহ-মমতায় বুকে তুলে নিতে লাগলেন । মাত্র পাঁচ টাকা মূলধন নিয়ে তিনি যে মিশনারীজ অব চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছিলেন । তা আজ সারা বিশ্বে সম্প্রসারিত হয়েছে শত শাখা-প্রশাখায় । এই সেবাব্রতের শাখা বাংলাদেশেও রয়েছে । মানবতার সেবা ও শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য তিনি বহুদেশে, বহু শিশুভবন, মহিলা কর্মকেন্দ্র, ভ্রাম্যমান চিকিৎসা কেন্দ্র, খাদ্য ও বস্ত্র বিতরণ কেন্দ্র এবং কুষ্ঠাশ্রম ইত্যাদি স্থাপন করেছেন । অবশ্য তিনি তাঁর এই বিপুল মানবতার সেবাব্রতের স্বীকৃতিও পেয়েছেন ।
পৃথিবীর ৫২টি দেশ জুড়ে মাদারের সেবাকেন্দ্র ছড়িয়ে। তাঁর মিশনারি অব চ্যারিটির বহু শাখা—কলকাতা শহরেই রয়েছে ৬০টি কেন্দ্র এবং শতাধিক সেবাকেন্দ্র। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে একশটিরও বেশি শাখা । সারা বিশ্বজুড়ে রয়েছে মাদারের প্রতিপত্তি। তাঁর সন্ন্যাসিনীদের সঙ্গে রয়েছে পুরুষ কর্মীর দল। তাঁদের বলা হয় ব্রাদার অব মিশনারিজ। একই মনে, একই বিশ্বাসে সন্ন্যাসিনীদের সঙ্গে তাঁরাও সমান ভাবে কাজ করে চলেছেন।
প্রথমে মিশনারিজ অব চ্যারিটি ছিল কলকাতার আর্চ বিশপের অধীন । তারপর থেকে তা ভ্যাটিকানের পোপের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে এসেছে। নিজের প্রতিষ্ঠানের নিয়ম কানুন বেঁধে দিয়েছেন মাদার স্বয়ং। অন্যান্য রোমান ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনীদের মত এই সংগঠনের সদস্যরাও দারিদ্র্য, সততা এবং নিয়মানুবর্তিতার শপথ গ্রহণ করেন। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের দারিদ্র্যের শপথ অত্যন্ত কঠোরভাবে পালন করা হয়। মাদারের ভাষায় — “to be able to love the poor and know the poor we must be poor ourselves.” মাদারের যেমন, তেমনি তাঁর সন্যাসিনীদেরও সম্বল বলতে গুটি কতক নীলপাড় মোটা শাড়ি, একটি প্রার্থনার বই এবং একটি ক্রুশ। তাঁরা আত্মীয়স্বজনের কোন সাহায্য নেন না, নিজের প্রতিটি কাজ নিজের হাতেই করেন। এযুগে অবিশ্বাস্য মনে হবে যে মাদার হাউসে কোনও বৈদ্যুতিক পাখা নেই। কেবল আগন্তুক আর অতিথিদের জন্য কয়েকটি আছে।
মতিঝিলের বস্তির শুরুর দিনগুলো থেকে মাদার হেঁটেই চলাফেরা করতেন। ১৯৬৪ খ্রিঃ তাঁর ব্যবহারের জন্য পোপ ষষ্ঠ পল ভারতে এলে নিজের সাদা লিঙ্কন কন্টিনেন্টাল লিমুজিন গাড়িটি দান করেছিলেন। মাদার সেই গাড়ি ব্যবহার করেননি। সেটাকে নিলামে বিক্রি করে কুষ্ঠরোগীদের আবাস নির্মাণ করেছিলেন। কলকাতাকে কেন্দ্র করেই মায়ের সেবাব্রতের মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। কলকাতার বাইরে প্রথম আশ্রম তৈরি হতে মাদারকে সময় নিতে হয়েছিল দশ বছর । রাঁচি থেকে বেশ কিছু মেয়ে যোগ দিয়েছিল মাদারের সঙ্ঘে। তাই তাদেরই তিনি উপহার দিয়েছিলেন কলকাতার বাইরের প্রথম আশ্রমটি —সিস্টার্স অব চ্যারিটি (১৯৬০ খ্রিঃ)। তারপর তিনি দিল্লীতে তৈরি করলেন শিশুভবন। এই ভবনের দ্বারোদঘাটন করেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। সঙ্গে ছিলেন সুইস রাষ্ট্রদূত এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন। দিল্লীর পর বোম্বাই ও অন্যান্য অংশে সেবাশ্রম স্থাপনের পর মাদার পা বাড়ালেন বহির্ভারতের আঙিনায়। তিনি গেলেন ভেনেজুয়েলা, রোম, কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ব্রাজিল, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ, অস্ট্রেলিয়া, জর্ডন, ইয়েমেন প্রভৃতি দেশে।
১৯৭৬ খ্রিঃ ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে প্রায় কুড়িটি আশ্রম তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ভারতের বাইরে। মানবতার প্রতিমূর্তি মাদার টেরিজার পৃথিবীজুড়ে এই যে বিশাল কর্মযজ্ঞ,তার জন্য প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। অথচ এই অর্থাগমের সরাসরি কোন উৎস নেই। সমস্তটাই নির্ভর করে বিভিন্ন মানুষ ও সংস্থার দানের ওপরে। অর্থের বিষয়ে মাদার পরিপূর্ণভাবে ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীল। তিনি কেবল প্রার্থনা করেন। জানেন না কোথা থেকে অর্থের সংস্থান হবে। অথচ প্রয়োজন মত সবই এসে হাজির হয় তাঁর পদপ্রান্তে। ধনী দরিদ্র, শিক্ষিত অশিক্ষিত মানুষের এরকম কোন ভেদ ছিল না মাদারের কাছে। দরিদ্রসেবায় ধনীর দান যেমন তিনি গ্রহণ করতেন, তেমনি দরিদ্রতম মানুষটির ভিক্ষা করে সংগ্রহ করে আনা তুচ্ছতম দানটিও পরম আদরে দুহাত পেতে গ্রহণ করতেন।
ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছেন শিবজ্ঞানে জীবসেবার কথা । বিবেকানন্দ সেই পথ আমাদের দেখিয়েছেন। কিন্তু মাদারের মধ্যে এই ব্রতের পূর্ণাঙ্গরূপটি মূর্ত হয়ে উঠেছিল। তাঁর সেবার ক্ষমতাটি ছিল অলৌকিক । আমাদের মত সাধারণের চোখে যা অবিশ্বাস্য। অথচ তিনি ছিলেন আমাদেরই মধ্যে দীনের হতে দীন। ছোট্ট অপরিসর একটি ঘরে, কেবল একটি মাত্র জানালা তাতে, মাটিতে পাতা বিছানায় তিনি ঘুমোতেন। মিশনারিজ অব চ্যারিটির সূত্রে জানা যায় মাদার নিজের জন্য মাসে ব্যয় করতেন মাত্র ষাটটি টাকা। এর মধ্যেই খাওয়া, পরা, ওষুধ ইত্যাদি। সাদা শাড়ি, নীল পাড়, মাথায় ঘোমটা, ছোট্ট শরীর, ধীরে ধীরে কথা-বলা এই মানুষটিকে নিয়ে গোটা বিশ্বের মানুষ সমান আগ্রহী। কেবল মাত্র দুটি শব্দ ‘মাদার টেরিজা’–এর কাছে নকল, খাঁটি, উঁচু, নীচু, ভন্ড, সাধু, শয়তান সকলের মাথা আনত । স্বয়ং ঈশ্বর মানবাকৃতি নিয়ে উপস্থিত হলেও পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষের কাছে এমন শ্রদ্ধা ভক্তি, আনুগত্য পেতেন কিনা সন্দেহ। মাদার তাঁর কর্মের মধ্যেই মহীয়সী। পৃথিবীতে এমন একটি মানুষও ছিল না যে মাদারের কোন কথা প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা রাখতো ।
১৯৮৫ খ্রিঃ রাষ্ট্র সঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেল পেরেজ দ্য কুয়েলার মাদার সম্পর্কে এক সভায় বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মানবী’। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী অপার শ্রদ্ধা মেশানো গলায় বলেছিলেন, মাদার কথা শোনেন না। অর্থাৎ তাঁর কথা না মেনে উপায় নেই। ভ্যাটিকানে পোপের প্রাসাদে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না। মাদারের জেদে পোপ পল বাধ্য হলেন যিশুর আপন জনদের জন্য সেখানে একটি আবাস নির্মাণ করতে। এই ছিলেন মাদার টেরিজা । আর যা কিছু তিনি করেছেন যখন যেখানে, সবই করেছেন দীনের হতে দীন—অধম অবাঞ্ছিত, অবহেলিত, ক্ষুধাপীড়িত রোগপীড়িতদেরই জন্য।
পুরস্কার ও সম্মাননা: মানুষকে ভালবাসার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মাদার টেরিজা । গোটা বিশ্ব তা স্বীকার করেছে আবনত মস্তকে, দুহাত ভরে পুরস্কার দিয়েছে তাঁকে।
১৯৬২ খ্রিঃ ভারত সরকার পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেছে। সেবছরই মাদারকে দেওয়া হয় ম্যাগসেসে পুরস্কার। ১৯৬৭ খ্রিঃ ষষ্ঠ পোপ পলের হাত থেকে গ্রহণ করেন ২৩তম পোপ জন শান্তি পুরস্কার। একই বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে তাঁকে দেওয়া হয় গুড সামারিটান পুরস্কার ।
একমাস পরেই পান জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অ্যাওয়ার্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং পুরস্কার। আধ্যাত্মিকতা বিকাশের স্বীকৃতি হিসেবে ইংলন্ডের প্রিন্স ফিলিপ ১৯৭৩ খ্রিঃ মাদারের হাতে তুলে দেন টেম্পলটন অ্যাওয়ার্ড ফর প্রগ্রেস ইন রিলিজিয়ন । ১৯৭৪ খ্রিঃ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পেলেন মেটার এট ম্যাজিসট্রো পুরস্কার।
মানবতার সেবার স্বীকৃতি স্বরূপ শান্তির জন্য মাদার টেরিজাকে ১৯৭৯ সনে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় । ১৯৮০ খ্রিঃ পেলেন ভারত সরকারের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ভারত রত্ন।
নোবেল পুরস্কারের ১৫ লক্ষ টাকা এবং অন্যান্য পুরস্করের প্রায় এক কোটি টাকা সবই তিনি দান করেন মানবতার সেবায় । নোবেল পুরস্কারের অর্থ দিয়ে মাদার টেরিজা কুষ্ঠ রোগীদেরে জন্য গড়ে তোলেন একটি চিকিৎসা ও সেবাকেন্দ্র ।
মাদারকে অমর করে রাখার সব চেয়ে বড় প্রয়াসটি রাষ্ট্রপুঞ্জের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অরগানাইজেশান-এর। বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে যাঁরা দুমুঠো অন্ন পৌঁছে দেন তাঁদের তরফে এই স্বীকৃতি হল সেরেস মেডেল। এই মেডেলের এক পিঠে রয়েছে ভিক্ষাপাত্র হাতে অপুষ্টিতে ভোগা একটি শিশুর মূর্তি। অপর পিঠে আছে মাদার টেরিজার মূর্তি।
স্বাস্থ্যহানি ও মৃত্যু: সময় অসময় বিচার না করে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন মাদার। ফলে ১৯৮৪ খ্রিঃ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বুকে পেসমেকার লাগাতে হয়। তবুও পৃথিবী জুড়ে তাঁর ছোটাছুটির বিরাম ছিল না। বারবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ডাক্তারদের প্রাণপণ চিকিৎসা ও সেবাযত্নে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কাজে। এভাবেই এগিয়ে নিয়ে এসেছেন তিনি তাঁর জীবনের অন্তিম লগ্ন। মহাপ্রয়াণের কিছুদিন আগে থেকে হুইল চেয়ারেই চলাফেরা করতে হতো।
১৯৯৭ খ্রিঃ ৬ সেপ্টেম্বর কলকাতায় মাদার হাউসে মানবতার প্রতিমূর্তি মাদার টেরিজা ৮৬ বছর বয়সে তাঁর প্রিয় ও আরাধ্য ভগবান যিশুর কোলে চির আশ্রয় লাভ করেন। সমগ্র পৃথিবী হল মাতৃহারা ।
References
পাঁচশত মনীষীর জীবনকথা, চক্রবর্তী সুবোধ
বিশ্বের ১০১ ব্যত্তিত্ব, আহমেদ আশরাফ
মনীষীদের জীবনকথা, শাহানা ফেরদৌস
নির্বাচিত জীবনী সমগ্র, ঘোষ নচিকেতা
বিশ্ব মনীষা শতক, সেন পৃথ্বীরাজ
The 100 Michael, H. Hart
101 Great Lives, Ajay Kumar Kothari, Vishwa Mithra Sharma