সূতীর ইতিহাস – সায়ন্তন মজুমদার

সাহিত্য দর্পণ

সূতী – নামটি শুনলেই মনে আসে তিন নবাবের কথা, কানে আসে অস্ত্রের ঝংকার। কিন্তু সূতীর গুরুত্ব শুধু যুদ্ধক্ষেত্র হিসাবেই নয়, এর ইতিহাস আরো প্রাচীন, ভূপ্রাকৃতিক দিক থেকে সূতী ‘রাঢ়’ অঞ্চলভুক্ত। একে অবশ্য চীনা পর্যটক হিউ-য়েন-সাঙ বর্ণিত ‘কজঙ্গল’ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্তও বলা যায়। কজঙ্গল বলতে রাজমহল ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলকেই বোঝায়। বর্তমান প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় যে সূতী – ১ এবং সূতী – ২ ব্লকের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ২ অক্টোবর ১৯৫৯ সালে, সেই সূতী অঞ্চল যে সপ্তম শতকের (আজ থেকে প্রায় ১৩০ বছর আগে) কজঙ্গল সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত তা ভাবাই যায় না। বর্তমানে সূতী – ১ এবং সূতী – ২ ব্লকের মোট আয়তন ২৪৯. ৫৮ বর্গকিমি। ২০০১ সালের জনগণনানুযায়ী জনসংখ্যা ৩,৫২,৪৮৮ জন।

মুর্শিদাবাদ বিষয়ে বহু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ রচয়িতা বহরমপুর শহরের গুরুদাস সরকার ছিলেন ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন গ্রন্থ আবিষ্কর্তা বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভের ঘনিষ্ঠ। তিনি সূতীর দহরপাহাড় গ্রাম নিবাসী অন্নদাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত একটি পুঁথি পেয়েছিলেন। পুঁথিতে লিখিত আছে যে উড়িষ্যার গঙ্গাবংশীয় নৃপতিগণ সূতীর কাছে ভাগীরথী অতিক্রম করেছিলেন। গঙ্গা বংশীয় রাজাদের সময়কাল আনুমানিক ত্রয়োদশ শতাব্দী বা তারও পূর্ববর্তী দ্বাদশ শতাব্দী। এই কথার পিছনে সন্দেহ থাকলেও একে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিভিন্ন তাম্রশাসনে এবং ভুবনেশ্বরের (উড়িষ্যা) বিষ্ণু মন্দির প্রতিষ্ঠার শিলালিপি থেকে জানা যায় যে অনন্তবর্মা চোড় গঙ্গদেব (১০৭৭- ১১৪৮ খ্রীষ্টাব্দ আনুমানিক) গঙ্গাতটস্থ স্থান থেকে কর সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি গোদাবরী থেকে গঙ্গা পর্যন্ত এক বিস্তীর্ণ ভূভাগের অধিকারী হয়েছিলেন।

স্বনামধন্য গুরুদাস সরকার সূতী থেকে একটি মূল্যবান শিলালিপি ১৯১৭-১৮ সাল নাগাদ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে (কলকাতা) নিয়ে যান। পরিষদের চব্বিশ বর্ষে, সপ্তম মাসিক অধিবেশনে তিনি সূতীর ইতিহাস সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধও পাঠ করেন। শিলালিপিটি একটি মসজিদের প্রতিষ্ঠা লিপি। বিশেষ ব্যাপার হল লিপির ভাষা তৎকালে প্রচলিত আরবি কিন্তু অক্ষর তোগরা। শিলালিপিটি থেকে জানা যায় যে এই মসজিদটি চাঁদ মালিকের পুত্র মোকররর্ খাঁ, সুলতান হোসেন শাহর আমলে প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদটির নাম ছিল জামি মসজিদ। বর্তমানে মসজিদটির সামান্যতম অবশিষ্ট নাই। লিপি থেকে জানা যায় মসজিদটি ৯০৯ হিজরী সালে অর্থাৎ ১৫০৩-০৪ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

‘বাংলার আকবর’ সুলতান হোসেন শাহ সূতী অঞ্চলে পদার্পণ করেছিলেন একথা বলাই যায়। কারণ দক্ষিণের সাগরদিঘী থানার চাঁদপাড়া ছিল তাঁর কর্মভূমি। হোসেন শাহর নামানুসারেই হয়ত বর্তমান সূতী – ১ ব্লকের হোসেনপুর গ্রামের নামকরণ হয়েছে। হোসেন শাহের আগেই মুর্শিদাবাদ থেকে রাজমহল হয়ে দিল্লীগামী একটি রাজপথ ছিল। এই  রাজপথের পাশেই অবস্থিত সূতী ও সন্নিহিত দহরপাহাড়, মঙ্গলপুর, অরঙ্গাবাদ। এই রাজপথ কে নির্মাণ করেছেন জানা যায় না। তবে পাঠান সুলতান প্রথম সেকেন্দার শাহ তাঁর রাজত্বকালে (১৩৫৮-১৩৯০ খ্রীষ্টাব্দ) এই রাজপথের দু’ধারে প্রচুর বৃক্ষরোপণ করে সড়কটিকে “ছায়া সুনিবিড়” করে তুলেছিলেন। এই রাজপথ দিয়ে আরোহণ কালেই হোসেন শাহর মাকে উপহাস করেছিলেন জীয়ৎপুড়ির তীবররাজার অনুচরবর্গ। ফলে হোসেন শাহ সেই তীবর রাজবংশকে ধ্বংস করেছিলেন। পরবর্তীকালে মোগল সম্রাট শাহ আলমের আদেশে মেজর রেনেল ১৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দে এই বিখ্যাত রাজপথটির মানচিত্র তৈরী করেছিলেন। এটির দৈর্ঘ্য ছিল ৫১৯ ক্রোশ। এই রাস্তা রাজমহল, পাটনা, মোগলসরাই, বারাণসী, আগ্রা হয়ে দিল্লী পর্যন্ত প্রসারিত। ১৮৭১ সালে মুর্শিদাবাদ কালেক্টরেটের রিপোর্টে সূতী – রাজমহল রুটের একটি উল্লেখযোগ্য কাঁচা রাস্তার কথা জানা যায়। তার দৈর্ঘ্য ২৯.৫ মাইল।

এবার আসা যাক মোগল আমলে। ১৫৮২ সালে টোডরমলের ব্যবস্থা অনুসারে ১৯ টি সরকারের মধ্যে সূতী অঞ্চল সম্ভবতঃ সরকার ‘ওড়ম্বর’-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাংলার দ্বার স্বরূপ তিলিয়া গড্ডী, শকরীগলি থেকে রাজমহল হয়ে ভাগীরথী অতিক্রম করে চুনাখালি পরগণা পর্যন্ত ছিল এর সীমা।

১৬৬৬ সালে বিখ্যাত পর্যটক তাভার্নিয়ার সূতীতে আসেন। সম্ভবতঃ বার্নিয়ারও এসেছিলেন এখানে নৌকাযোগে। তাভার্নিয়ারের লিখিত একটি পত্র থেকে জানা যায় পলি – বালি পড়ে সূতী নদীর তৎকালীন অবস্থার কথা। মোগল সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বের শেষ দিকে তাঁর পুত্রদের মধ্যে বিবাদ ঘটে। সুজা সেই সময় বাংলার সুবাদার ছিলেন। তাঁকে সরাবার জন্য ঔরঙ্গজেব মীরজুমলাকে পাঠান ১৬৫৯ সালে। মীরজুমলার সাথে সুজার বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ হয়েছিল এই সূতীতে। ২৮ শে ডিসেম্বর সূতীর কাছে চিলামারীতে মারাত্মক সংঘর্ষ হয়। শেষ পর্যন্ত সুজা সূতী নদী পেরিয়ে ১৬৬০ সালের ৯ই জানুযারী অপর পারে চলে যেতে বাধ্য হন। সুজার পর মীরজুমলাকে বাংলার সুবাদার করা হয়। তৎকালীন রাজনৈতিক পালাবদলে সূতী বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল তা বোঝা যায় ।

এর পর গৌরবমণ্ডিত নবাবী আমলের কথা শুরু করা যাক। ১৭২২ সালে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলাকে ১৩ টি চাকলায় ভাগ করেন। এই সময় সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ছিল মুর্শিদাবাদ চাকলা। রাজশাহী, বীরভূম, নদীয়া, ফতেসিংহ, সাতসইকা, রুকনপুর, লস্করপুর, চাঁদলই জমিদারীও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। সূতী অঞ্চল যে সেসময় চাকলা মুর্শিদাবাদের  অন্তর্ভুক্ত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় লস্করপুর স্থানটির উল্লেখ থেকে। ১৭৪০ সালে গিরিয়া যুদ্ধ রক্তে রঞ্জিত হয়। তৃতীয় নবাব সরফরাজ খাঁ এবং ভাবী চতুর্থ নবাব আলিবর্দী খাঁয়ের মধ্যে এ স্থানে যুদ্ধ হয়। গিরিয়াতে সরফরাজ ও আলিবর্দী শিবির গড়েছিলেন। রিয়াজ-উস-সালাতিনে লিখিত আছে সরফরাজপক্ষীয় সেনাপতি গওস খাঁ গিরিয়া নালায় শিবির গড়েছিলেন। ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায়ের মতে এই গিরিয়া নালা বর্তমানে ভাগীরথীর পশ্চিমে বালিস্তূপে অবলুপ্ত। এটি তৎকালে ভাগীরথীর পূর্ব তীরে অবস্থিত ছিল। এই গিরিয়া নালাতেই গওস খাঁর সাথে আলিবর্দী পক্ষীয় নন্দলালের যুদ্ধ হয়েছিল। ভাগীরথী বর্তমানে পশ্চিম থেকে অনেকটাই পূর্বে চলে আসায় এই গিরিয়া নালা বর্তমানে পশ্চিমপাড়ে চড়ে পরিণত হয়েছে। যাই হোক গিরিয়া স্থানটি একটি গৌরবমণ্ডিত স্থান, কারণ মুর্শিদাবাদের নবাবদের মধ্যে একমাত্র সরফরাজ খাঁ-ই বীর শহীদের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু বরণ করেছিলেন। নবাবের মাহুতের চেষ্টায় নবাবের মৃতদেহ অতি গোপনে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়া হয়। গিরিয়ার প্রান্তরে সেনাপতি গওস খাঁ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মৃতিতে মমিনটোলা গ্রামের চাঁদপুরে একটি দরগা নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে সেসব ভাগীরথী গর্ভে আশ্রয় নিয়েছে। স্মরণে রাখা প্রয়োজন গিরিয়া প্রান্তর ভাগীরথীর উভয় পারেই বিস্তৃত। সরফরাজ – আলীবর্দীর যুদ্ধ উভয় পারেই হয়েছিল। কিন্তু ১৭৬৩ সালের আগষ্টে মীরকাশীমের সাথে ইংরেজদের যুদ্ধ কেবলমাত্র ভাগীরথীর পশ্চিম পারেই হয়েছিল, সূতী থেকে বাঁসলই নদীর মোহনা পর্যন্ত। বলা বাহুল্য মীরকাশীম যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালান। এই বিখ্যাত গিরিয়া মাঠের আজ নানা পরিবর্তন হয়েছে। হয়ত ভাগীরথী এই অপমানিত রক্তাক্ত ক্ষেত্রকে রাখতে চান নি। অধিকাংশই তাঁর গর্ভে পর্যবসিত হয়েছে। নানাভাবে এই মাঠ ছিন্নভিন্ন ও গর্ভস্থ হওয়ার পরে বিক্ষিপ্তাকারে এখনো অবস্থান করছে লালখাঁর দিয়াড়, কুন্দলিয়া মাঠ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে। এই অঞ্চলের যুদ্ধস্মৃতিপূর্ণ আরও কয়েকটি স্থান হল আলমপুর, রায়পুর, সুলতানপুর ।

  কোম্পানীর শাসনে সূতী অঞ্চলে ‘ইংলিশ’ নামে একটি গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই গ্রাম হিংস্র জন্তুদের আবাস ছিল। ইষ্ট ইন্ডিয়া কেম্পানীর পক্ষ থেকে ফৌজের নায়েক, সুবাদার প্রমুখ কর্মচারীরা অস্থায়ীভাবে নিষ্কর দিয়ে এখানে গ্রাম পত্তন করেছিলেন। ১৮৫৪ – ৫৫ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহের কালে এই গ্রামে জনৈক আনন্দ চন্দ্র গাঙ্গুলীর কথায় অহেতুক ত্রাসের সঞ্চার হয়েছিল। ফৌজি আইনের কবলে পড়ে, অবশেষে স্যার অ্যাসলি ইডেনের সহযোগিতায় রক্ষা পান তিনি!

থানা হিসাবে সুতীর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় গ্যাসট্রেলের রেভিনিউ সার্ভের প্রতিবেদন থেকে, ১৮৫১-৫২ সালে। ১৯০১ সালে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ড্রেনেজ কমিটির প্রতিবেদনে সূতী ছিল একটি স্বাস্থ্যকর স্থান। সূতী অঞ্চলে প্রথম রেললাইন স্থাপিত হয় ১৯১৩ সালের ৩১ শে জানুয়ারি, ধুলিয়ান গঙ্গা থেকে জঙ্গিপুর রোড পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের মাধ্যমে।

এবার সুতীর বিশেষ স্থানের এবং মনীষীর বিবরণ দেওয়া যাক

সূতী – ১ ব্লক

বহুতলি বিহারের সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। এখানে পাঠান আমলের মালিক দেওয়ান সাহেবের সমাধি রয়েছে। এখানকার বহুতলি হাই স্কুল ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত ।

  বংশবাটী গ্রামে প্রাচীন পুকুর এবং সাতটি বড় দিঘী রয়েছে। দক্ষিণে রাজুয়া দিঘী নবাব কর্মচারী রাঘব বিশ্বাসের খনিত। আশ্চর্যের ব্যাপার দিঘীটির মাঝে প্রায় দশ বিঘা স্থান জুড়ে প্রাচীরবেষ্টিত চৌবাচ্চা রয়েছে। দিঘীর প্রত্যেক ঘাটের উপর মন্দির ছিল। এখানকার রাজরাজেশ্বরী মন্দিরে মৃন্ময়ী ষোড়শী মূর্তি পূজিত হয়। এই উপলক্ষ্যে মাঘ মাসে মেলা বসে। ঊনিশ শতকের প্রথমে লালগোলার রাজা রামশংকর রায় (যোগীন্দ্রনারায়ণের পূর্বসূরী) নাকি ভাগীরথীতে ভাসমান পক্ষীরূপী প্রস্তরমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে বৃদ্ধেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে সে মূর্তি অপহৃত। বংশবাটী হাইস্কুল ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত।

হারোয়াতে বিখ্যাত পদকর্তা সৈয়দ মর্তুজা এবং তার সাধনসঙ্গিনী অনন্দময়ীর নকল সমাধি রয়েছে। এখানকার চড়ক উৎসব বিখ্যাত। এখানে একটি হাইস্কুল রয়েছে।

হিলোড়ার শ্যামসুন্দর মন্দির বিখ্যাত। প্রায় চারশো বছর আগে একজন বৈষ্ণব সাধক বাজিতপুর মন্দির থেকে শ্যামসুন্দরের দারুমূর্তি এনে প্রতিষ্ঠা করেন। পুরাতন মন্দির ধূলিসাৎ হলে মুরারই নিবাসী হনুমানপ্রসাদ ভকত বিশাল মন্দির নির্মাণ করে দেন। রাণী ভবানী এবং নবাব বংশীয়া আশরফউন্নেশা বেগম এই মন্দিরে বহু নিষ্কর জমি দান করেছিলেন। লোকসংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবে এখানকার গড়িয়া দেবীর পূজা ও গান পশ্চিমবঙ্গের আর কোন স্থানে দেখা যায় না। বিশেষ একপ্রকার হাতপুতুল শিল্পটি টিকিয়ে রেখেছেন শিল্পী চন্দ্রশেখর ঘোষ এবং তার পুত্র। এখানকার অমরেন্দ্রনাথ দাস বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। অনেকেই জানেন না যে বিখ্যাত চিত্র পরিচালক তপন সিংহের পৈর্তৃক নিবাস ছিল এই হিলোড়ায়। এখানকার জমিদার ত্রিদিবেশচন্দ্র সিংহ ছিলেন কাব্যরসিক, নাট্যরসিক মানুষ। তাঁরই পুত্র তপন সিংহ। জমিদার বাড়িতে একটি পাকা নাট্যমঞ্চও ছিল।

বাঁসলই একটি বিশেষ বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। W.W. হান্টারের Statistical Accounts of Bengal (1876) থেকে জানা যায় একসময় এই নদী দিয়ে ৫০ মণি (২ টন) নৌকা যাতায়াত করত। গিরিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধের সময় ইংরেজরা এই নদীর উপর সেতু নির্মাণ করেছিলেন।

সাদিকপুরে রয়েছে মুখার্জী বংশীয় জমিদারদের বাস। জমিদারদের উদ্যোগেই বসন্তকুমারী হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬০ সালে। ১৮৫০ সাল নাগাদ এখানে একটি নীলকুঠিও ছিল।

১৮৫০ সাল নাগাদ হোসেনপুর, নয়াবাহাদুরপুর, নূরপুর গ্রামেও নীলকুঠি ছিল। নূরপুরে ১৮৫৩ সালে নীলকুঠির কর্মচারীরা জমিদারদের বলদ কেড়ে নেয়। সংঘর্ষ বাঁধলে জমিদারপক্ষীয় কায়েম খাঁ নিহত হন। কুঠির অধ্যক্ষ মি. টেইলরের কোন সাজা হয় নি।

এই অঞ্চলের বিশেষ বিশেষ মেলাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য আহিরণের খেজুর পঞ্চমী উৎসব (আশ্বিন মাস), রমাকান্তপুরের রক্ষাকালীপূজা (চৈত্রমাস) ইত্যাদি।

সূতী – ১ ব্লকে মোট ন’টি উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে। তার মধ্যে প্রাচীন বিদ্যালয়টি হল ফতুল্লাপুর শশীমণি হাইস্কুল, ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত।

এবার সূতী – ২ ব্লকের প্রসঙ্গে আসা যাক

ঔরঙ্গাবদের নামকরণ হয়েছে মুঘল সম্রাট ওরঙ্গজেবের নামানুসারে। সেই আমলে এখানে একটি সেনানিবাস ছিল। আরবী অক্ষর শোভিত প্রস্তরখণ্ড, সিঁড়িযুক্ত প্রাচীন ইঁদারা রয়েছে এখানে। এখান থেকে বাদশাহী স্বর্ণমুদ্রাও পাওয়া গিয়েছে। সূতী অঞ্চলের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন স্কুল হল ঔরঙ্গাবাদ হাই স্কুল, ১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠিত। প্রাচীন কালে এই অঞ্চল একটি বিশেষ বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। নীল বিদ্রোহে এই অঞ্চলের অবদান ছিল সর্বাধিক। এখানে বিশাল নীলকুঠি ছিল। কুঠিয়াল অ্যানড্রুজ, গোমস্তা তুফাজিল হোসেনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সর্ববৃহৎ সশস্ত্র গণআন্দোলন ঘটে এখানে। নেতৃত্ব দেন মোরাদ বিশ্বাস, সৌহাস বিশ্বাস, লালচাঁদ সাহা, যাদববন্ধু ঘোষ। ওরঙ্গাবাদের বিশেষ উৎসবগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অগ্রহায়ণ মাসের অনন্তব্রহ্মাপূজা, ১৮৮৩ সালের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় তৎকালে এখানে একটি ডাকঘর ছিল। মিষ্টান্ন শিল্পেও উন্নত ছিল এস্থান। বলা হয় রসকদম্বের উৎপত্তি নাকি এখান থেকেই। নিকটবর্তী বাগশিরাপাড়ায় জমিদার বাড়ির রাধাগোবিন্দ মন্দির উল্লেখযোগ্য। এখানে কার্যোপলক্ষে নিযুক্ত ছিলেন স্যার অ্যাসলী ইডেন ।

জগতাই গ্রামের গোস্বামীদের ঠাকুরবাড়ির রাধাবল্লভের বিগ্রহ দু’শো বছরের প্রাচীন। এঁরা অদ্বৈত আচার্য্যের বংশধর। জগতাই গ্রাম রত্নগর্ভা। এই গ্রামেরই ভূমিপুত্র ছিলেন বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার। তাঁর জন্ম ১৮৯১ সালে। নিমতিতার জমিদার মহেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর পরামর্শে তিনি কলকাতার গভঃ আর্ট স্কুলে ভর্তি হন । এখানেই তিনি শিক্ষক রূপে পান অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। পরবর্তীতে তিনি ইণ্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল – এর অধ্যক্ষ হন, পরবর্তীতে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। তাঁর চিত্র সংগ্রহ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, লর্ড হার্ডিঞ্জ। তিনি সুগায়ক ও সুদক্ষ অভিনেতাও ছিলেন। তাঁর কীর্ত্তন গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর বিখ্যাত চিত্র সংকলনগ্রন্থ হল ‘চিত্রে গীতগোবিন্দ’। ১৯৭৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী তিনি অনন্তলোকে যাত্রা করেন।

ক্ষিতীন্দ্রনাথের বাল্যবন্ধু নলিনীকান্ত সরকার এই গ্রামেই ১৮৮৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কবি, গায়ক, স্বাধীনতা সংগ্রামী। ‘বিজলী’, ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ, নজরুল, দাদাঠাকুরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁর লেখা গ্রন্থগুলি হল – ‘দাদাঠাকুর’, ‘হাসির অন্তরালে’, ‘আসা যাওয়ার মাঝখানে’, ‘শ্রদ্ধাস্পদেষু’ ইত্যাদি। ১৯৪৮ সালে পণ্ডিচেরী অরবিন্দ আশ্রমে তিনি প্রয়াত হন।

বাজিতপুরের সর্বেশ্বর মন্দির খুব বিখ্যাত। ভাগীরথীতে ভাসমান, দারুনির্মিত বিগ্রহগুলি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সৈয়দ মর্তুজা। সর্বেশ্বরের প্রতীক বিগ্রহ যাদব রায়ের অষ্টধাতুর মূর্তি অপহৃত। পূর্বতন মোহান্তদের সমাধিগুলিও পাশে আছে। মাঘ মাসের প্রথম রবিবার ‘সূর্য-উপবাস’ ব্রত উদ্যাপন উপলক্ষ্যে বিশাল মেলা হয়। মন্দিরগাত্রে সূতীর দ্বিতীয় যুদ্ধের চিত্র উৎকীর্ণ আছে।

মহেশাইলে হোসেন শাহের দরবার উচ্চপদস্থ কর্মচারী রাজা মঙ্গল সেনের বাসস্থান বলে কথিত। তাঁর বংশধরদের বাড়িতে একটি স্থানক বৌদ্ধমূর্তি রয়েছে। এস্থানের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় বস্তু মহেশাইল দিঘী। এই গ্রামেরই উত্তরপূর্বে কুন্দলিয়া মাঠ (মীরকাশিমের স্মৃতিবিজড়িত)।

লক্ষ্মীপুর একটি বিশিষ্ট গ্রাম। ১৮৪৫ সালে ঔরঙ্গাবাদ নীলপ্রতিষ্ঠানের দুটি নীলকুঠি এই গ্রামে অবস্থিত ছিল। এখানকার ছাবঘাটিতে মুঘল আমলের প্রসিদ্ধ বন্দর ছিল। এই ছাবঘাটিতে আস্তানা নির্মাণ করেছিলেন সৈয়দ মর্তুজা।

এখানেই তিনি দেহত্যাগ করেন। তিনি সপ্তদশ শতাব্দীর শক্তিশালী পদকর্তা ছিলেন। তাঁর আনন্দময়ী নামে সাধনসঙ্গিনী ছিল। তাঁর সমাধি ভাগীরথী গর্ভস্থ হবার পর ভক্তরা এখানকার মাটি তুলে নিয়ে গিয়ে হিলোড়ায় নকল সমাধি তৈরি করেছেন। তাঁর রচিত একটি বিখ্যাত পদ – “শ্যাম বন্ধু চিতনিবারণ তুমি/কোন শুভ দিনে, দেখা তোমা সনে, পাসরিতে নারি আমি।” এই অঞ্চলের অপর একজন বিখ্যাত পদকর্তা হলেন নাসির মামুদ। এখানকার ছাবঘাটী হাইস্কুল ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত। সূতী – ২ ব্লকে উচ্চবিদ্যালয় আছে মোট দশটি।

তথ্যসূত্র

  1. মুর্শিদাবাদের ইতিহাস – নিখিলনাথ রায় ।
  2. মুর্শিদাবাদ কাহিনী – নিখিলনাথ রায় ।
  3. বাঙ্গলার ইতিহাস (নবাবী আমল) – কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় ।
  4. History of Murshidabad – Major Walsh
  5. পশ্চিমবঙ্গের পুরাসম্পদ, মুর্শিদাবাদ – বিজয় কুঃ ব্যানার্জী
  6. Murshidabad District Gazetters – L. S. S. Omalliye
  7. Murshidabad District Gazetters – Birendra K. Bhattacharya.
  8. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত – অসিত কুঃ ব্যানার্জী।
  9. ঝড় পত্রিকা,
  10. গণকন্ঠ পত্রিকা ।
  11. মুর্শিদাবাদ জেলা গেজেটিয়ার ২০০৩।
  12. মুর্শিদাবাদ থেকে বলছি – কমল ব্যানার্জী ।
  13. চেনা মুর্শিদাবাদ অচেনা ইতিবৃত্ত – সৌমেন্দ্র কুঃ গুপ্ত।
  14. হিউয়েন সাঙের ভারত ভ্রমণ বৃত্তান্ত
  15. Statistical Accounts of Bengal – W. W. Hunter.
  16. Murshidabad District, A Cultural Diversity – Debashri Das.
  17. The Life & time of cantoobabu – Somendra Chandra Nandy.
  18. মুর্শিদাবাদ কথা – শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *